Friday, June 22, 2018

একজন পপ সম্রাটের গল্প



শুধু গিটার বাজিয়ে তো আর সংসার চলে না। টানাপোড়েনের দিনে ক্রেন অপারেটরের কাজও নিতে হয়েছে জোসেফকে। স্ত্রী ক্যাথরিনও দুই পয়সা আয়ের জন্য ক্ল্যারিনেট আর পিয়ানো বাজান। দুই কক্ষের ছোট্ট বাড়িতে ছেলেপেলে অনেক। এদেরকে কাজে লাগিয়ে দিলে খরচ উঠে যায়! এরাও গান-বাজনা আয়ত্তে এনে গানের দল গঠন করে ফেলল। কিশোর বয়সী পাঁচ ভাই মিলে দলের নাম দিল ‘জ্যাকসন ফাইভ’। ষাটের দশকে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে জ্যাকসন পরিবারের এই দল। তবে দর্শক-শ্রোতার মন কেড়ে নেয় সবচেয়ে ছোট সদস্য মাইকেল। অথচ কঠোর পিতা চাননি মাইকেল গান করুক। ভাইয়েরা জোর করে বাবাকে মাইকেলের গান শুনতে বলে। শোনার পর বাবা আর না করতে পারেননি। দল থেকে বের হয়ে মাইকেল শুরু করেন তাঁর একক ক্যারিয়ার। ধীরে ধীরে সংগীতের দুনিয়ায় নিজেকে নিয়ে যান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। পপ, রক, ব্লুজের মিশেলে তৈরি করেন গানের এক অন্য জগৎ। সঙ্গে যোগ করেন নিজের অনন্য নাচ। বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে বনে যান পপসম্রাট। হ্যাঁ, তিনি সেই মাইকেল জ্যাকসন, যিনি কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে মারা যান পঞ্চাশ বছর বয়সে।
সেদিন ছিল ২৫ জুন। ঠিক এই মাসটাই। সাল ২০০৯। অতিরিক্ত প্রপোফল সেবনে মৃত্যু হয় পপসম্রাটের। কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না বলে চিকিৎসককে একরকম জোর করেই ওষুধ দিতে বলেন। তারপর সেই যে ঘুমালেন আর জাগলেন না।


প্রথম যেদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছিলেন মাইকেল, সেদিনটা ছিল ২৯ আগস্ট, ১৯৫৮। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার গ্যারিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে জন্ম নেন তিনি। গায়ের রংটা কালোই ছিল। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কী যে এক বদখত ত্বকের রোগ দেখা দিল তাঁর। চামড়ার রং সাদা হতে শুরু করে। ট্যাবলয়েডগুলো ছাপতে থাকে প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে নাকি তিনি ফরসা হতে চেয়েছেন। কিন্তু এসব খবরে খুব দুঃখ পান মাইকেল। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি শুধু নাকের সার্জারি করিয়েছিলেন, ত্বকের না। এটা ছিল তাঁর ত্বকের রোগ। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ রোদে গেলে কালো হয়ে যায়। আর আমার হয় ঠিক তার উল্টো। কই তখন তো অন্যদের কেউ জিজ্ঞেস করে না তাঁরা কেন কালো হয়েছে। এটা আমার রোগ। আমি কিছুই করতে পারব না।’ চামড়ার রঙের অস্বাভাবিক তারতম্যের জন্য তিনি ভারী মেকআপ ব্যবহার করতেন সব সময়। তবে একটা সময় নিজের চেহারা নিয়ে খুব মন খারাপ হতো তাঁর। কৈশোরে বাবা তাঁকে ‘কুৎসিত’ বলতেন। চেহারায় অনেক ব্রণ হতো। নিজের মুখটা আয়নায় দেখতে ভয় পেতেন। একবার এক নারী ভক্ত জ্যাকসন ফাইভকে দেখে ছোট্ট মাইকেলকে খুঁজছিলেন। কিন্তু তাঁকে দেখে খুব হতাশ হলেন। লজ্জায় মাইকেলের তখন কোথাও পালিয়ে যেতে মন চাইছিল। বাবা যে শুধু মাইকেলকে এসব নিয়ে ত্যক্ত করতেন তা নয়, পরিবারের সবাইকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখতেন জোসেফ জ্যাকসন। বাচ্চাগুলোকে ধরতে পারলে খুব পেটাতেন। কোনোরকম ভুল করা যেত না কোনো কাজে। দশ ভাইবোনের মধ্যে মাইকেল ছিলেন অষ্টম। ছোট বলে রেহাই মিলত না তাঁর। এসব ঘটনা মাইকেলকে দুঃখ দিলেও বাবাকে অনেক ভালোবাসতেন তিনি।
হয়তো শৈশব সুখের হয়নি বলেই নিজের প্রাসাদতুল্য বাড়ি ‘নেভারল্যান্ড’-এ শিশুদের জন্য তৈরি করে গেছেন আমিউজমেন্ট পার্ক। ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুরা তাঁর এই পার্কে আসত। তিনি নিজে তাঁদের বিনোদনের খোরাক হতেন। অসুস্থ শিশুদের জন্য বিশেষ বিছানার ব্যবস্থাও আছে। শুয়ে শুয়ে মজার সব শো দেখতে পায় বাচ্চারা। যিনি শিশুদের এত ভালোবাসতেন, তাঁর বিরুদ্ধেই কিনা দুইবার ওঠে শারীরিকভাবে শিশুদের লাঞ্ছিত করার অভিযোগ। কিন্তু কোনোবারই তাঁকে অভিযুক্ত প্রমাণ করা যায়নি। এই মানুষটা নিজেকে মন থেকে পিটার প্যান হিসেবে দাবি করেছিলেন। যে পিটার প্যান কোনো দিন বুড়িয়ে যায় না। শিশুর মতো যার মন। ভক্তরাও বিশ্বাস করেনি শিশু মনের মানুষটা এমন জঘন্য কাজ করবে।
একবার গুজব ওঠে, নেভারল্যান্ডে এমন এক কক্ষ আছে, যেটায় মাইকেল ঘুমান। সেটা নাকি অক্সিজেন কক্ষ। এই কক্ষে ঘুমালে নাকি অনেক বছর বেশি বাঁচা যায়। ট্যাবলয়েডগুলোর এহেন খবরে খুব অবাক হয়েছিলেন মাইকেল। হাসতে হাসতে পরে বলেন, ‘এমন কোনো কক্ষ নেভারল্যান্ডে নেই। আমি এমন কোনো কক্ষে ঘুমাই না।’
মিউজিক ভিডিও’ কথাটায় খুব একটা নজর দেননি মাইকেল। তিনি এগুলোকে মনে করতেন স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি, সংগীতের ছবি। তাঁর ছবিতে থাকত গল্প। সেই সঙ্গে যোগ করেছিলেন নিজের উদ্ভাবিত নাচ ‘মুনওয়াক’। এখনো তাঁর সেই সব মিউজিক্যাল ছবি সাফল্যের শীর্ষে। তাঁর থ্রিলার অ্যালবামটি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত হিসেবে নাম লিখিয়েছে। আশি সপ্তাহ ধরে শীর্ষ তালিকায় ছিল ১৯৮২ সালের এই অ্যালবাম। বত্রিশ সপ্তাহ ছিল প্রথম স্থানে। গ্র্যামিতে ১২টি মনোনয়ন পেয়ে ৮টিই বাগিয়ে নেন মাইকেল জ্যাকসন। নিজেকে তিনি মনে করতেন সংগীতের উপাদান, ছন্দের গোলাম। তাই থেমে থাকতেন না কখনো। ছন্দ শুনলে আপনা আপনি নেচে উঠতেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। কখনো ভেবেচিন্তে নাচেননি। আর তাঁর এমন নাচই হয়ে গেল অনন্য। তিনি হয়ে গেলেন নৃত্যশিল্পীও। প্রয়াতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনি সব সংগীত তারকার শীর্ষে রয়েছেন।
পপসংগীতের সম্রাটের উপাধি তিনি পেয়েছিলেন হঠাৎ করেই। হলিউড তারকা এলিজাবেথ টেলর তাঁকে একবার পুরস্কার প্রদানকালে হুট করে বলে ফেলেছিলেন, ‘পপ-রকের সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন’। এরপর মাইকেলের বাড়ির সামনে ভক্তরা ভিড় জমিয়ে সমস্বরে ধ্বনি দিতে থাকে, ‘কিং অব পপ, কিং অব পপ’। সেই থেকে তিনি হয়ে গেলেন ‘কিং অব পপ’ বা পপসম্রাট।
আদর্শ ছিলেন আরেক কিংবদন্তি সংগীত তারকা এলভিস প্রিসলি। তাঁর মেয়ে লিসা মেরি প্রিসলিকে ভালোবেসে বিয়ে করেন ১৯৯৪ সালে। কিন্তু দেড় বছরের বেশি টেকেনি সেই সংসার। মাইকেলের মৃত্যুর পর লিসা জানান, মাইকেলকে চিকিৎসকেরা এত বেশি ওষুধ দিতেন যে লিসার মনে হয়েছিল বাবার মতোই স্বামীর অবস্থা হবে। হয়তো বাবার মতোই হঠাৎ একদিন বাথরুমে মৃত পাওয়া যাবে মাইকেলকে। ঘাবড়ে গিয়েছিলেন লিসা। মাইকেলের শরীরের ব্যথা আর ঘুম না হওয়ায় অনেক ওষুধ সেবন করতে হতো। এদিকে মাইকেল চাইতেন ফুটফুটে সন্তান দিয়ে ভরে যাক তাঁর ঘর। কিন্তু লিসা প্রস্তুত ছিলেন না। রাগ করে মাইকেল বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে সন্তান না দিতে চাইলে ডেবি দেবে, ও বলেছে আমাকে।’ ডেবি ছিলেন মাইকেলের নার্স। এ কথা শুনে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন লিসা। ছেড়ে চলে আসেন মাইকেলকে। বাধা দিয়েছিলেন মাইকেল। কিন্তু লিসা তখন ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বীকার করেন। তাঁদের বিচ্ছেদের পর সেই ডেবি রোয়িকে বিয়ে করেন মাইকেল ১৯৯৬ সালে। তাঁদের ঘরে জন্ম হয় প্রিন্স আর প্যারিস জ্যাকসনের। ডেবিও বেশিদিন মাইকেলের ঘরে থাকলেন না। তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ১৯৯৯ সালে। মাইকেলের তৃতীয় সন্তান ব্ল্যাঙ্কেটের জন্ম হয় সারোগেসির মাধ্যমে।
সন্তান ও ভাইবোনদের খুব ভালোবাসতেন তিনি। তাঁদের ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করতেন। এই যে এত খ্যাতি তিনি পেলেন জ্যাকসন ফাইভ থেকে সরে এসে, এতে কি ভাইদের মনে আঘাত লাগেনি, হিংসা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে সাফ জানিয়েছিলেন মাইকেল, ভাইয়েরা তাঁকে অনেক ভালোবাসেন। তাঁর সাফল্যে ভাইয়েরা অনেক বেশি খুশি। এই খুশিটা এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। ভাইবোনেরা তাঁদের সাক্ষাৎকারে সব সময় মাইকেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। মাইকেলের মৃতদেহ কাঁধে নেওয়ার মতো দুঃখ হয়তো তাঁর ভাইয়েরা কোনো দিন পাননি।
মাইকেল হয়তো প্রথম স্ত্রী লিসাকে সারা জীবন ভালোবেসে গেছেন। নয়তো শেষের দিকে ফোন দিয়ে লিসাকে জিজ্ঞেস করতেন না, ‘তুমি কি আমাকে এখনো ভালোবাসো?’ লিসা উত্তরটা নিজেও জানতেন না। উত্তর পেয়েছিলেন মাইকেলের মৃত্যুর পর। এখনো ভালোবাসেন। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, লিসা যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছিলেন, তার ঠিক অপর পাশের বাড়িতেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন মাইকেল জ্যাকসন।
 ‘ওয়াকো জ্যাকো’ ডাক নামটা মোটেও পছন্দ ছিল না মাইকেলের। তাই ‘পপসম্রাট’ই সই। এই সম্রাটকে একনজর দেখতে, একটু ছুঁয়ে দিতে, হায় মানুষের সে কী স্রোত, কী চিৎকার! এমনটা আর কারও বেলায় এত করে হয়েছে কি? একজন সম্রাটের গল্প তো এমনই হয়।
সূত্র : প্রথম আলো

Sunday, June 10, 2018

মরুর মুক্তা পালমিরা




 
পালমিরা হচ্ছে প্রাচীন সেমিটিক শহর যা বর্তমান দিনে সিরিয়ার হমস প্রদেশে অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক গণ নিয়োলিথিক যুগের সন্ধান পেয়েছেন এখানে এবং নগরটি সম্পর্কে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের প্রথমভাগে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১ম শতাব্দীতে পালমিরা রোমানদের হাতে আসার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্রাটের হাতে এসেছে।
তাদমোর নামটি দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিক থেকে পরিচিত ছিলো; মারিতে প্রাপ্ত আঠারো খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শিলালিপিতে একে উল্লেখ করা হয়েছে তা-আদ-মি-ইর, অন্যদিকে ১১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আশারিয় লিপিতে লেখা হয়েছে তা-আদ-মার। আরামিক পালমারিন লিপিতে নামের দুটি ধরণের উল্লেখ আছে তাদমার এবং তাদমোর। নামের উৎপত্তি পরিষ্কার নয়। আলবার্ট স্কাল্টেনস সমর্থিত আদর্শ অনুবাদ খেঁজুরের সেমিটিক শব্দ তামারের সংগে যুক্ত করে যা দ্বারা বোঝা যায় শহরটিকে ঘিরে প্রচুর খেঁজুর গাছ বিদ্যমান ছিলো।
গ্রীক নাম Παλμύρα (লাতিন রূপ পালমিরা) প্রথম উল্লেখ করেন প্লিনি দ্যা এল্ডার ১ম খ্রিস্টাব্দে। এটা গ্রীকো-রোমান বিশ্বে ব্যবহৃত হতো। এটা সাধারণত ভাবা হয়ে থাকে পালমিরা তাদমোর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ভাষাবিদেরা দুটি সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করেছেন; একটি মতে পালমিরা তাদমোরের পরিবর্তেও ব্যবহৃত হতো। স্কালটেন্সের মতে তাদমোরে একটি ভগ্নরূপ তালমুরা যা লাতিন শব্দ পালমা'র (খেঁজুর) প্রভাবে পালমুরাতে পরিবর্তিত হয়েছে। খেঁজুর গাছের জন্য শেষপর্যন্ত পালমিরা চূড়ান্ত নাম হিসেবে প্রচলিত হয়। দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে, যেমন জ্যঁ স্টারক্কির মতে, তাদমোরকে গ্রীকে অনুবাদ করার সময়ে তাদমোরকে এভাবে অনুবাদ করা হয় কারণ একে খেঁজুর ভাবা হয়।

হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা

তৃতীয় খ্রিস্ট শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং শেষের দিকে (২৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে) পালমিরা তার সভ্যতার উৎকর্ষে পৌঁছে। ততদিনে পালমিরাতে তৈরি করা হয়েছিলো Great Colonnade আর Temple of Bel এর মত বিখ্যাত সব স্থাপত্যগুলো। এগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। আর তাই ইউনেস্কো এগুলোকে World heritage Site বলে ঘোষণা করেছিলো। অনেকেই হয়তো এই জায়গাগুলোর ছবি দেখেছেন। নিচে দেখতে পাচ্ছেন Temple of Bel এর ছবি।
রাণী জেনোবিয়ার সময় এই শহরের নিদর্শনগুলোর ওপর একবার হামলা চলে। আপনারা অনেকে হয়তো আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে রোমান সম্রাট অওরেলিয়ানের (Aurelian) হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানেন। সেই হামলার সূত্রপাত এই পালমিরার রাণী জেনোবিয়ার বিদ্রোহ দমন করতে গিয়েই হয়েছিলো। ২৭৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে সম্রাট অওরেলিয়ান আলেকজান্দ্রিয়াতেও হামলা করেছিলেন, অনেক নিদর্শন ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি এখানেও হামলা করে নিদর্শনগুলোর ওপর এক হাত নিয়েছিলেন। শহরের লোকেরা আগে প্যাগান (বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজক) ছিলো, পরে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলো। পরে আরেক রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান কিছু কিছু নিদর্শন পুনঃনির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু একবার ধ্বংস করে ফেললে পুরোটা কি আর পারা যায়?
এরপর বিশ্ব সম্মুখীন হলো আরেক ধর্মের, ইসলাম। পালমিরা’র লোকেদের ভাষা হয়ে গেলো আরবী। যাই হোক, ততদিনে পালমিরা তার গৌরব হারিয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের পর পালমিরা উৎকর্ষের কেন্দ্র থেকে সরে গেছে। অনেক বছর এভাবে চলার পর সুন্নি মুসলিম সম্রাট তৈমুরের বংশধরেরা, ১৪০০ সালের দিকে আরেক দফা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এবারের ধ্বংসকার্য শহরটাকে মামুলি একটা গ্রামে রুপান্তরিত করে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে পালমিরা’র অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আক্ষরিক অর্থেই মাটি খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসেন প্রত্নতত্ত্ববিদের দল। তারা অত্যন্ত যত্নে বেশ কিছু নিদর্শন বের করে নিয়ে আসেন। ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো এই এলাকাটাকে সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে World Heritage Site হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে প্রচুর পর্যটক সমাগম হতো। কিন্তু সিরিয়ার ক্রান্তিলগ্নে অনেক কিছুই পাল্টে গেলো। ১৯৯৯ এর দিকে ISIS আত্মপ্রকাশ করলো, তখন অবশ্য ওদের নাম ISIS ছিলো না। ২০১৪ এর দিকে নামটা ISIS (Islamic State of Iraq and Syria) বা IS (Islamic State) বা ISIL (Islamic State of Iraq and the Levant) হয়েছিলো। নিদর্শনগুলোর কফিনে সর্বশেষ পেরেকটা এরাই ঠুকলো।





Saturday, June 9, 2018

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার




 
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব (৭৮১-৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন।
পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে। আয়তনে এর সাথে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই শুধু নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার (তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে।

অবস্থান ও আয়তন

পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষ (বর্তমান বানগড়)-এর মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর মহাবিহার। এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। অপরদিকে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব পশ্চিমদিকে মাত্র ৫ কিলোমিটার।

ইতিহাস ও পটভূমি

৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হিউয়েন সাং পুন্ড্রবর্ধনে আসেন, তবে তার বিস্তারিত বিবরণে সোমপুরের বিহার ও মন্দিরের কোন উল্লেখ নেই। গোপালের পুত্র ধর্ম পাল (৭৮১ - ৮২২ খ্রি) সিংহাসনে আরোহণ করে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন ও রাজ্যকে বাংলা বিহার ছাড়িয়ে পাকিস্তানের উত্তর - পশ্চিম সীমান্তের গান্ধার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। সম্রাট ধর্মপাল অনেক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ছিলেন ও তিনিই বিক্রমশীলা ও সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য মতে, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ "পাগ সাম জোন ঝাং" এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন। সোমপুর বিহারের ভিক্ষুরা নালন্দা, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি ভারতীয় বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থানে অর্থ ও ধন রত্ন দান করতেন বলে বিভিন্ন লিপিতে উল্লেখ করা আছে, যা ১০ম - ১১শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধশীল অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়া ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমপুর বিহার ছাড়াও অগ্রপুর (রাজশাহীর অগ্রাদিগুণ), উষ্মপুর, গোটপুর, এতপুর ও জগদ্দল ( রাজশাহীর জগদল) বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৯ম শতাব্দীর শেষভাগে গুর্জর রাজ প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্র পাল, পাল সাম্রাজ্যের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেন। পরে ১০ম শতাব্দীর শেষভাগে পাল বংশীয় রাজা মহীপাল (৯৯৫ - ১০৪৩) সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন ও সোমপুর বিহার মেরামত করেন। কিন্তু মহীপাল ও তার পুত্র নয়াপালের মৃত্যুর পর আবার পাল বংশের পতন শুরু হয়। এই সুযোগে মধ্যভারতের চেদীরাজ কর্ণ, চোলরাজ রাজেন্দ্র ও দিব্বো নামের এক দেশীয় কৈবর্ত সামন্ত নরপতি পর পর বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন। নালন্দায় পাহাড়পুর মন্দির ও বিহার ধ্বংসের উল্লেখ সম্ভবত এ সময়ের আক্রমণের। ১১শ শতাব্দীতে পাল বংশীয় রামপাল হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ১২শ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট থেকে আগত সেন রাজারা বাংলা দখল করেন। সে রাজদের আমলে সোমপুর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। এ সময় শেষবারের মত সোমপুরের পতন শুরু হয়। ১৩শ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ - বিন - বখতিয়ার খিলজী বাংলায় আক্রমণ করে উত্তরবঙ্গের বৃহদাংশ দখল করে নেন। সম্ভবত এই মুসলমান শাসকদের মূর্তিবিরোধী মনোভাবের ফলেই বৌদ্ধদের এই বিহার ও মন্দির সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যায়।



প্রত্নতাত্ত্বিক খনন

পাহাড়পুরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যকে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্বকালীন সময়ে মূলত বৃটিশ যুগে, এবং দ্বিতীয়ত স্বাধীনতা-উত্তর কালে আশির দশকে। ১৮৭৯ সালে কানিংহাম প্রথম উদ্যোগটি নেন। কিন্তু বলিহারের জমিদারের বিরোধিতায় কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগ খনন করে তাঁকে থেমে যেতে হয়। এ খননে চারপাশে উদগত অংশযুক্ত প্রায় ৭মি উঁচু একটি কক্ষ আবিষ্কৃত হয়। এর দীর্ঘদিন পর ১৯২৩ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র গবেষণা পরিষদ ও ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় এবং দিঘাপতিয়ার জমিদার পরিবারের সদস্য শরৎ কুমার রায়ের অর্থানুকূল্যে পুনরায় খননকাজ শুরু হয়। এ বছর ঐতিহাসিক ডি.আর.ভান্ডারকরের নেতৃত্বে প্রত্নস্থলটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে খনন পরিচালিত হলে উত্তর-দক্ষিণে বিন্যস্ত একসারি কক্ষ এবং চত্বরের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় ১৯২৫-২৬ সালে খনন করে কেন্দ্রীয় ঢিবির উত্তরে প্রধান সিঁড়ি, পোড়ামাটির ফলকচিত্র শোভিত দেয়াল ও প্রদক্ষিণ পথসহ উত্তর দিকের মন্ডপ বা হল ঘর আবিষ্কার করেন। ফলে প্রথমবারের মত এ বিহারের ভূমিপরিকল্পনা ও দেয়ালচিত্রণ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে জি.সি.চন্দ্র বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ও সংলগ্ন চত্বর খনন করেন। ১৯৩৩-৩৪ সালে কাশিনাথ দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ পুনরায় খনন করে। এতে বিহার ও মন্দিরের অবশিষ্ট অংশ এবং সত্যপীরের ভিটায় একগুচ্ছ স্তূপসহ একটি তারা মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রফিক মোঘল পূর্ব বাহুর কয়েকটি কক্ষে গভীর উৎখনন পরিচালনা করেন।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৮১-৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ 'নতুন তথ্যের অনুসন্ধান এবং ইতোপূর্বে দীক্ষিতের আবিষ্কৃত কক্ষসমূহের প্রাপ্ত নিদর্শনাবলী সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া'র উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের খনন কাজ শুরু করে। ১৯৮৭-৮৯ সালে পুনরায় খনন পরিচালিত হয় বিহার অঙ্গন থেকে অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল ও পূর্ববর্তী খননের স্তূপীকৃত মাটি অপসারণ করে সুশৃঙ্খল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যেন বিহারে বিদ্যমান জলাবদ্ধতা দূরীভূত হয় এবং লবণাক্ততা হ্রাস পায়।

স্থাবর স্থাপত্য নিদর্শনসমূহ

বিহার

বৌদ্ধ বিহারটির ভূমি-পরিকল্পনা চতুষ্কোনাকার। উত্তর ও দক্ষিণ বাহুদ্বয় প্রতিটি ২৭৩.৭ মি এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাহুদ্বয় ২৭৪.১৫ মি। এর চারদিক চওড়া সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা দেয়াল বরাবর অভ্যন্তর ভাগে সারিবদ্ধ ছোট ছোট কক্ষ ছিল। উত্তর দিকের বাহুতে ৪৫টি এবং অন্য তিন দিকের বাহুতে রয়েছে ৪৪টি করে কক্ষ। এই কক্ষগুলোর তিনটি মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি মেঝে বিছানো ইঁটের ওপর পুরু সুরকী দিয়ে অত্যন্ত মজবুত ভাবে তৈরি করা হয়েছিলো। সর্বশেষ যুগে ৯২টি কক্ষে মেঝের ওপর বিভিন্ন আকারের বেদী নির্মাণ করা হয়। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, প্রথম যুগে সবগুলো কক্ষই ভিক্ষুদের আবাসকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীকালে কিছু কক্ষ প্রার্থনাকক্ষে রুপান্তর করা হয়েছিলো।
কক্ষগুলোর প্রতিটিতে দরজা আছে। এই দরজাগুলো ভেতরের দিকে প্রশস্ত কিন্তু বাইরের দিকে সরু হয়ে গেছে। কোন কোন কক্ষে কুলুঙ্গি পাওয়া যায়। কুলুঙ্গি সম্বলিত কক্ষগুলোর মেঝেতে দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য বেশ কিছু দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। ভেতরের দিকে কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য ৪.২৬ মি এবং প্রস্থ ৪.১১ মি। কক্ষের পেছনের দিকের দেয়াল অর্থাৎ সীমানা দেয়াল ৪.৮৭মি এবং সামনের দেয়াল ২.৪৪মি চওড়া। কক্ষগুলোর সামনে ২.৫ মি. প্রশস্ত টানা বারান্দা আছে। ভেতরের দিকের উন্মুক্ত চত্বরের সাথে প্রতিটি বাহু সিঁড়ি দিয়ে যুক্ত।
বিহারের উত্তর বাহুর মাঝ বরাবর রয়েছে প্রধান ফটক। এর বাইরের ও ভেতরের দিকে একটি করে স্তম্ভ সংবলিত হলঘর এবং পাশে ছোট ছোট কুঠুরি আছে। এই কুঠুরিগুলো বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত। প্রধান ফটক এবং বিহারের উত্তর-পূর্ব কোনের মাঝামাঝি অবস্থানে আরও একটি ছোট প্রবেশ পথ ছিলো। এখান থেকে ভেতরের উন্মুক্ত চত্বরে প্রবেশের জন্য যে সিঁড়ি ব্যবহৃত হত তা আজও বিদ্যমান। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম বাহুতেও অনুরুপ সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিলো। এদের মাঝে কেবল পশ্চিম বাহুর সিঁড়ির চিহ্ন আছে। উত্তর বাহুর প্রবেশ পথের সামনে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একটি পুকুর ছিল। ১৯৮৪-৮৫ সালের খননে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম নির্মাণ যুগের পরবর্তী আমলে এ পুকুর খনন করা হয় এবং এসময় এ অংশের সিঁড়িটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরবর্তীকালে পুকুরটি ভরাট করে দেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় মন্দির

বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত চত্বরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। এখন এটি ২১মি উঁচু হলেও মূল মন্দিরটি কমপক্ষে ৩০ মি উঁচু ছিল। তিনটি ক্রমহ্রাসমান ধাপে ঊর্ধ্বগামী এ মন্দিরের ভূমি-পরিকল্পনা ক্রুশাকার। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ১০৮.৩ মি ও ৯৫.৪৫মি। কুশের মধ্যবর্তী স্থানে আরও কয়েকটি অতিরিক্ত দেয়াল কৌণিকভাবে যুক্ত। মূল পরিকল্পনাটির কেন্দ্রে দরজা-জানালা বিহীন একটি শূন্যগর্ভ চতুষ্কোণাকার প্রকোষ্ঠ আছে। এই প্রকোষ্ঠটি মন্দিরের তলদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। মূলতঃ এ শূন্যগর্ভ প্রকোষ্ঠটিকে কেন্দ্র করেই সুবিশাল এ মন্দিরের কাঠামো নির্মিত। এ কক্ষের চারদিকে মন্দিরের দ্বিতীয় ধাপে চারটি কক্ষ ও মন্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলেই মন্দিরটি ক্রুশাকার ধারণ করেছে। মন্দির পরিকল্পনার সমান্তরালে দেয়াল পরিবেষ্টিত প্রদক্ষিণ পথ আছে। অনুরুপভাবে প্রথম ধাপে দ্বিতীয় ধাপের প্রদক্ষিণ পথের দেয়ালের চারদিকে চারটি কক্ষ যুক্ত করে ক্রুশাকৃতি বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে এবং এর সমান্তরালে প্রদক্ষিণ পথ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপের সমান্তরালে মন্দিরের ভিত্তিভূমির পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। উত্তর দিকের মধ্যবর্তীস্থলে সিঁড়ি ছিল। পরবর্তিতে এ সিঁড়ি ধ্বংস করে তার উপর কিছু নতুন কাঠামো নির্মাণ করা হয়।
কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষে একটি ইঁট বাধানো মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ মেঝে কক্ষের বাইরে চারদিকের কক্ষ ও মন্ডপের প্রায় একই সমতলে অবস্তথিত। কিন্তু চারদিকের কক্ষগুলো থেকে কেন্দ্রীয় এ কক্ষে যাওয়ার কোন পথ বা দরজা নেই এবং আগে ছিলো,পরে বন্ধ করা হয়েছে এমন কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না। কক্ষে মূর্তি রাখার বেদী বা কুলুঙ্গী কিছুই নেই। তাই অনুমিত হয় ফাঁপা এ দন্ডটি মন্দিরের সুউচ্চ দেয়ালগুলোর সুদৃঢ় নির্মানের জন্য একটি উপকরণ ছিল। মূর্তিগুলো সম্ভবত এর চারদিকের কক্ষগুলোতে স্থাপন করা হয়েছিলো। মন্দিরের শীর্ষদেশের কোন নিদর্শন নেই বিধায় এর ছাদ সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কিছু বলা যায় না।
কেন্দ্রীয় শূন্যগর্ভ কক্ষটির দেয়াল নিরাভরণ কিন্তু প্রতিটি ধাপের দেয়ালগুলোর বহির্ভাগ উদগত কার্নিশ, অলংকৃত ইঁট এবং সারিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলকচিত্র দ্বারা সজ্জিত। ক্রুশাকার পরিকল্পনার বর্ধিত অংশগুলোর সংযোগস্থলে কার্নিশের প্রান্ত পর্যন্ত পানি নিষ্কাশন নালার ব্যবস্থা আছে। পাথর নির্মিত এ নালাগুলোর মুখ গর্জনরত সিংহের মুখের অবয়বে নির্মিত। ভিত্তিভূমির দেয়ালের বহির্দেশে ৬৩টি কুলুঙ্গি আছে। এর প্রতিটিতে একটি করে পাথরের ভাস্কর্য ছিলো।

উন্মুক্ত অঙ্গন

বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে আরও কিছু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এদের মাঝে বেশ কিছু ইমারতের বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ভোজনশালা ও রন্ধনশালা অবস্থিত। এ দুটি স্থাপনার মাঝে ৪৬মি দীর্ঘ ইট বাঁধানো একটি নর্দমা আছে এবং এর কাছে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। এছাড়াও রয়েছে কিছু নিবেদন স্তূপ, প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি। নিবেদন স্তূপগুলোর মাঝে দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত স্তূপটি ১৬কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্র আকৃতির। অনুচ্চ একটি মঞ্চের মাঝে সংস্থাপিত এ স্তূপটির সংলগ্ন স্থানে রয়েছে একটি পাকা কূপ। অন্যান্য নিবেদন স্তূপগুলো বিক্ষিপ্তভাবে নির্মিত। চত্বরের উত্তর-পূর্বাংশের ইমারতগুলো সম্ভবত প্রশাসনিক এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হত।

স্নানাগার ও শৌচাগার

এটি মূলত বিহারের বাইরের অবস্থিত স্থাপনা। বিহারের দক্ষিণ দেয়াল হতে ২৭মি দক্ষিণে অবস্থিত একটি মঞ্চে অনেকগুলো স্নানাগার ও শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছিলো। মঞ্চটি পূর্ব-পশ্চিমে ৩২মি দীর্ঘ ও উত্তর-দক্ষিণে ৮.২৩ মি. প্রশস্ত। এটি বিহারের ১০২ নম্বর কক্ষ থেকে একটি উঁচু বাধানো পথ দ্বারা সংযুক্ত। এই পথের নিচে বিহার দেয়ালের সমান্তরালে ১.৯২মি চওড়া এবং ২.৫ মি. উঁচু একটি ভল্টযুক্ত খিলান রয়েছে। সম্ভবত বিহারের বহির্ভাগে অবাধে চলাচল এবং চারদিকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করার জন্য এইরুপ করা হয়েছিলো।