Sunday, June 10, 2018

মরুর মুক্তা পালমিরা




 
পালমিরা হচ্ছে প্রাচীন সেমিটিক শহর যা বর্তমান দিনে সিরিয়ার হমস প্রদেশে অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক গণ নিয়োলিথিক যুগের সন্ধান পেয়েছেন এখানে এবং নগরটি সম্পর্কে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের প্রথমভাগে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১ম শতাব্দীতে পালমিরা রোমানদের হাতে আসার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্রাটের হাতে এসেছে।
তাদমোর নামটি দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিক থেকে পরিচিত ছিলো; মারিতে প্রাপ্ত আঠারো খ্রিষ্টপূর্বাব্দের শিলালিপিতে একে উল্লেখ করা হয়েছে তা-আদ-মি-ইর, অন্যদিকে ১১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের আশারিয় লিপিতে লেখা হয়েছে তা-আদ-মার। আরামিক পালমারিন লিপিতে নামের দুটি ধরণের উল্লেখ আছে তাদমার এবং তাদমোর। নামের উৎপত্তি পরিষ্কার নয়। আলবার্ট স্কাল্টেনস সমর্থিত আদর্শ অনুবাদ খেঁজুরের সেমিটিক শব্দ তামারের সংগে যুক্ত করে যা দ্বারা বোঝা যায় শহরটিকে ঘিরে প্রচুর খেঁজুর গাছ বিদ্যমান ছিলো।
গ্রীক নাম Παλμύρα (লাতিন রূপ পালমিরা) প্রথম উল্লেখ করেন প্লিনি দ্যা এল্ডার ১ম খ্রিস্টাব্দে। এটা গ্রীকো-রোমান বিশ্বে ব্যবহৃত হতো। এটা সাধারণত ভাবা হয়ে থাকে পালমিরা তাদমোর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ভাষাবিদেরা দুটি সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করেছেন; একটি মতে পালমিরা তাদমোরের পরিবর্তেও ব্যবহৃত হতো। স্কালটেন্সের মতে তাদমোরে একটি ভগ্নরূপ তালমুরা যা লাতিন শব্দ পালমা'র (খেঁজুর) প্রভাবে পালমুরাতে পরিবর্তিত হয়েছে। খেঁজুর গাছের জন্য শেষপর্যন্ত পালমিরা চূড়ান্ত নাম হিসেবে প্রচলিত হয়। দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে, যেমন জ্যঁ স্টারক্কির মতে, তাদমোরকে গ্রীকে অনুবাদ করার সময়ে তাদমোরকে এভাবে অনুবাদ করা হয় কারণ একে খেঁজুর ভাবা হয়।

হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা

তৃতীয় খ্রিস্ট শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং শেষের দিকে (২৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে) পালমিরা তার সভ্যতার উৎকর্ষে পৌঁছে। ততদিনে পালমিরাতে তৈরি করা হয়েছিলো Great Colonnade আর Temple of Bel এর মত বিখ্যাত সব স্থাপত্যগুলো। এগুলো ইতিহাসের সাক্ষী। আর তাই ইউনেস্কো এগুলোকে World heritage Site বলে ঘোষণা করেছিলো। অনেকেই হয়তো এই জায়গাগুলোর ছবি দেখেছেন। নিচে দেখতে পাচ্ছেন Temple of Bel এর ছবি।
রাণী জেনোবিয়ার সময় এই শহরের নিদর্শনগুলোর ওপর একবার হামলা চলে। আপনারা অনেকে হয়তো আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে রোমান সম্রাট অওরেলিয়ানের (Aurelian) হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানেন। সেই হামলার সূত্রপাত এই পালমিরার রাণী জেনোবিয়ার বিদ্রোহ দমন করতে গিয়েই হয়েছিলো। ২৭৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে সম্রাট অওরেলিয়ান আলেকজান্দ্রিয়াতেও হামলা করেছিলেন, অনেক নিদর্শন ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি এখানেও হামলা করে নিদর্শনগুলোর ওপর এক হাত নিয়েছিলেন। শহরের লোকেরা আগে প্যাগান (বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজক) ছিলো, পরে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলো। পরে আরেক রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান কিছু কিছু নিদর্শন পুনঃনির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু একবার ধ্বংস করে ফেললে পুরোটা কি আর পারা যায়?
এরপর বিশ্ব সম্মুখীন হলো আরেক ধর্মের, ইসলাম। পালমিরা’র লোকেদের ভাষা হয়ে গেলো আরবী। যাই হোক, ততদিনে পালমিরা তার গৌরব হারিয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের পর পালমিরা উৎকর্ষের কেন্দ্র থেকে সরে গেছে। অনেক বছর এভাবে চলার পর সুন্নি মুসলিম সম্রাট তৈমুরের বংশধরেরা, ১৪০০ সালের দিকে আরেক দফা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এবারের ধ্বংসকার্য শহরটাকে মামুলি একটা গ্রামে রুপান্তরিত করে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে পালমিরা’র অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আক্ষরিক অর্থেই মাটি খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসেন প্রত্নতত্ত্ববিদের দল। তারা অত্যন্ত যত্নে বেশ কিছু নিদর্শন বের করে নিয়ে আসেন। ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো এই এলাকাটাকে সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে World Heritage Site হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে প্রচুর পর্যটক সমাগম হতো। কিন্তু সিরিয়ার ক্রান্তিলগ্নে অনেক কিছুই পাল্টে গেলো। ১৯৯৯ এর দিকে ISIS আত্মপ্রকাশ করলো, তখন অবশ্য ওদের নাম ISIS ছিলো না। ২০১৪ এর দিকে নামটা ISIS (Islamic State of Iraq and Syria) বা IS (Islamic State) বা ISIL (Islamic State of Iraq and the Levant) হয়েছিলো। নিদর্শনগুলোর কফিনে সর্বশেষ পেরেকটা এরাই ঠুকলো।





No comments:

Post a Comment